গর্ভবতীর যত্ন-আত্তি
গর্ভকালীন মায়ের চাই বিশেষ যত্ন। মহিলাদের গর্ভধারণের আগেই নিজের স্বাস্থ্য, গর্ভধারণ ও সন্তান পালনসংক্রান্ত বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার।
কারণ একজন সুস্থ মা-ই পারেন একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুর জন্ম দিতে। তাই গর্ভবতী মায়ের জন্য প্রয়োজন সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা। গর্ভকালীন যত্ন বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গর্ভকালে একজন নারীকে সাধারণত অসুস্থ বলা হয়। এমনকি কাছের মানুষের কথায় বা আচরণে বিভিন্নভাবে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। কিন্তু নারীর জীবনের স্বাভাবিক একটি অবস্থা গর্ভাবস্থা। প্রাকৃতিকভাবেই এই সময়টাতে তাঁর দৈহিক ও মানসিক কিছু পরিবর্তন হয়। তাই এই পরিবর্তনকে অসুস্থতা মনে করার সুযোগ নেই।
চেক-আপ
সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান জন্মদানের জন্য প্রত্যেক দম্পতির উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
এ জন্য তাঁর গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার, ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে দুবার এবং পরবর্তী সময়ে ডেলিভারির আগে সপ্তাহে একবার করে চেক-আপ করানো উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গর্ভকালীন ১৬ সপ্তাহ, ২৮ সপ্তাহ, ৩২ সপ্তাহ ও ৩৬ সপ্তাহে একবার করে কমপক্ষে মোট চারবার মেডিক্যাল চেক-আপ করা জরুরি। এ ছাড়া যেকোনো জটিলতা দেখামাত্র তাত্ক্ষণিকভাবে পরামর্শ নিতে হবে।
ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস
গর্ভবতী মা পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য তৈরি করা প্রায় সব খাবারই খেতে পারবেন। তবে শক্তিদায়ক খাবার, যেমন ভাত, রুটি বা পরোটা, আলু, চিনি, গুড়, সুজি, সয়াবিন তেল, বাদাম, কলিজা, ঘি অথবা মাখন বেশি খাবেন।
শক্তি ক্ষয়পূরণ ও নবজাতকের শরীর বৃদ্ধিকারক খাবার, যেমন মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ধরনের ডাল, মটরশুঁটি, সিমের বিচি ইত্যাদি খাবেন। রোগ প্রতিরোধক খাবার, যেমন সবুজ, হলুদ ও অন্যান্য রঙিন শাকসবজি, সব ধরনের দেশীয় টাটকা ফলমূল খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে। পানি পান করবেন দৈনিক অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার। ঘরে তৈরি দই, ফলের জুস, ফল কিংবা সবজির সালাদ ও স্যুপজাতীয় পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন। এ সময়টাতে নিয়মিতভাবে ক্যালসিয়াম ও আয়রন ট্যাবলেট সেবন করা উচিত।
দৈনন্দিন কাজ
কোনো রকম শারীরিক জটিলতা না থাকলে সন্তান জন্মের এক মাস আগে (৩৬ সপ্তাহ) পর্যন্ত স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারবেন একজন গর্ভবতী। গর্ভবতী মা কর্মজীবী হলে তিনি অফিসের স্বাভাবিক কাজ করতে পারবেন। ডেস্ক ওয়ার্ক বা অফিশিয়াল কাজে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে ফিল্ড ওয়ার্কের ক্ষেত্রে একটু সতর্ক হতে হবে। অধ্যয়নরত হলে অবশ্যই লেখাপড়ায় মনোযোগ দেবেন। কারণ সন্তান জন্মদানের পর মাকে সন্তানের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে। তখন হয়তো লেখাপড়ায় সময় তেমন দিতে পারবেন না। ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ হবু মা-ই ডেলিভারির কিছুদিন আগে ছুটি নিয়ে থাকেন, যেন ছুটির বেশির ভাগ সময় সন্তানের সঙ্গে কাটাতে পারেন। সব কিছু ঠিক থাকলে সে ক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।
ব্যায়াম
সুস্থতার জন্য কোনো রকম শারীরিক জটিলতা না থাকলে ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ, সাঁতার, ইয়োগা, সমতলে হাঁটাহাঁটির মতো হালকা ব্যায়ামগুলো করতে পারেন। তবে গর্ভকালীন কিছু ব্যায়াম নরমাল ডেলিভারির জন্য বেশ সহায়ক।
ঘুম ও বিশ্রাম
এ সময় হবু মায়ের পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন। রাতের বেলায় তিনি দৈনিক আট ঘণ্টা ঘুমাবেন। দিনের বেলায় সম্ভব হলে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেবেন। গর্ভবতী মা চাকরির কারণে বাড়ির বাইরে থাকলে বাড়িতে ফিরে অন্তত এক ঘণ্টা শুয়ে বিশ্রাম নেবেন। অবশ্যই রাতে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে, যেন সকালে আবার কাজে যেতে কোনো সমস্যা না হয়। সর্বোপরি যেকোনো সময় ক্লান্ত মনে হলেই সুযোগ করে বিশ্রাম নিলে ভালো হয়।
টিকা
কৈশোরে টিটি টিকার ডোজ সম্পন্ন থাকলে ভালো। আর যদি এই টিকা আগে না নেওয়া হয়, তাহলে গর্ভবতী অবস্থায় পাঁচ ও ছয় মাসে যথাক্রমে দুটি টিকা টিটি দিতে হবে।
পোশাক ও পরিচ্ছন্নতা
সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কারণ পরিচ্ছন্ন থাকলে শরীর ও মন ভালো থাকে। অন্যদিকে বিভিন্ন ইনফেকশনজনিত রোগ থেকেও রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। এ সময় ঢিলেঢালা নরম কাপড় পরিধান করা উচিত।
সতর্কতা
♦ গৃহস্থালির কঠিন কাজ, যেমন ধান মাড়াই, ধান ভানা, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, ভারি জিনিস উত্তোলনসহ অন্য কোনো ভারী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব কাজের জন্য স্বামী কিংবা পরিবারের অন্য কারো সাহায্য নিতে হবে।
♦ ভারী কোনো কিছু তোলা, দূরে যাতায়াত করা এবং ভারী কিছু বহন করা।
♦ শরীরে ঝাঁকি লাগে এমন কাজ করা, দীর্ঘ সময় কোনো কাজে লিপ্ত থাকা।
♦ ঝগড়াঝাটি ও ধমক দেওয়া, জর্দা, সাদাপাতা খাওয়া, তামাক, গুল ব্যবহার করা, ধূমপান বা অন্য কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা।
♦ স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ গ্রহণ করা।
বিশেষ পরামর্শ
ডেলিভারির আগে ব্লাড গ্রুপের সঙ্গে ম্যাচ করা তিন-চার ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগে। এ ছাড়া জরুরি প্রয়োজনের জন্য গাড়ি প্রস্তুত রাখা উচিত। আর শুরু থেকেই কিছু কিছু করে টাকা জমিয়ে রাখতে হবে যেন জরুরি প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায়। গর্ভবতীকে হাসি-খুশি রাখা ও সব সময় মৃদু স্বরে কথা বলা উচিত, যেন কোনো কারণে কোনো ব্যাপারে তিনি মানসিকভাবে কষ্ট না পান কিংবা দুশ্চিন্তা না করেন। অন্যদিকে পরিবারের সদস্য, যেমন স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, মা-বাবা বা অন্য সদস্যদের আরো বেশি সহিষ্ণু ও সহায়ক হতে হবে। এ ছাড়া বন্ধু ও সহকর্মীদের মানসিক সাপোর্ট এ সময় খুব বেশি প্রয়োজন হয়।
Post a Comment